by MOHAKAL | Jul 9, 2021 | জালালুদ্দিন রুমি বই, জীবনী, মসনবী শরীফ
শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ এর পরিচিতিঃ হযরত শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ -এর আসল নাম মুহাম্মদ ইবনে আবুবকর ইব্রাহীম। ফরীদউদ্দীন তাঁর ডাক নাম। ‘আত্তার’ ছদ্মনামে তিনি কাব্য সাধনা করতেন। এক সময় আতরের ব্যবসা করতেন বলে মুসলিম দুনিয়ায় তিনি ফরীদউদ্দীন আত্তার নামেই পরিচিত।
তাঁর জন্ম ৫১৩ হিজরী সনে। অবশ্য সন-তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। মধ্য এশিয়ার সুপ্রসিদ্ধ নিশাপুরে তাঁর জন্ম। তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণ মােটামুটি একমত। চেঙ্গিস খাঁর বাগদাদ আক্রমণের সময় এক তাতারীর হাতে তিনি নিহত হন। বাল্য ও কৈশাের জীবনে লেখাপড়া সম্পন্ন করে তিনি ওষুধের ব্যবসায় নিয়ােজিত হন।
এই সময়ের একটি ঘটনায় তাঁর জীবনধারার আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায়। একদিন তিনি তার দোকানে কর্মব্যস্ত এক ভিক্ষুক এসে দোকানে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। ব্যস্ততার দরুন তিনি কোন রূপ সাড়া না দেওয়ায় তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ভিক্ষুক আরও জোরে দ্বিতীয়বার ভিক্ষার দাবী জানায়। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হল না। তখন হতাশ হয়ে ভিক্ষুক বললেন, সামান্য পয়সা খরচ করতে তুমি এত কুণ্ঠিত। না জানি প্রিয় প্রাণটা দেওয়ার ব্যাপারে তুমি কিরূপ কর। ভিক্ষুকের কথাটি এবার কানে যায় ফরীদউদ্দীনের। বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি যেমন ভাবে প্রাণ দিবে, আমিও তেমন ভাবেই দিব?, বটে! ভিক্ষুক বলল, আমি যেভাবে দিব, তুমিও সেভাবেই দিবে? দেখা যাক, বলে সে তৎক্ষণাৎ তার কাঁধের ঝুলি মাথার নিচে দিয়ে মাটির ওপর শুয়ে পড়ে বার বার কলেমা তাইয়্যেবা, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আবৃত্তি করতে থাকে। আর ঐ অবস্থাতেই সে মারা যায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলেন ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ। ভিক্ষুকের দাফন কাৰ্য শেষ করে তিনি তার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় জিনিসপত্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সংসার বিরাগী হয়ে যান। প্রচুর ভাবান্তর সৃষ্টি হয় তার মনে। মানসিক প্রশান্তির সন্ধানে তিনি হাজির হন হযরত রুকনুদ্দীন আফাক রহমাতুল্লাহ-এর দরবারে। তার কাছেই তিনি মারেফাত জ্ঞানের পাঠ গ্রহণ করেন। পরে হজ্জ যাত্রায় মক্কা শরীফে গিয়ে সেখানে তরীকতের শিক্ষায় আত্মনিয়ােগ করেন। অবশেষে হযরত শেষ আজদুদ্দীন বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-এর কাছে মারেফাত জ্ঞানে দীক্ষিত হন। আর সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করে উচ্চ তত্ত্ব-জ্ঞানের অধিকারী হন।
তার মৃত্যু সম্পর্কে যা জানা যায়, তা এরকম- তাতারী দস্যুরা নিশাপুর আক্রমণ করে সেখানে অবাধ লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। হযরত ফরীদউদ্দীনও তাদের আক্রমণের শিকার হন। এক তাতারী যখন তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত, তখন কোন একজন বললেন, এ দরবেশকে হত্যা না করে, তার বদলে আমার কাছ থেকে দশ হাজার মোহর নাও। সঙ্গে সঙ্গে ফরীদউদ্দীন বলে ওঠেন, মাত্র দশ হাজার মােহরের বিনিময়ে আমাকে বিক্রি করাে না। আমার পাপ যে এর চেয়েও অনেক বেশী। আততায়ী প্রলুবন্ধ হয়ে উঠল। আরও বেশী অর্থ পাওয়ার লােভে সে তাকে নিয়ে পথে চলল।
কিছুদূর যাওয়ার পর অন্য একটি লোেক তাকে বন্দী অবস্থায় দেখে তাতারীকে বলল, তুমি হযরতকে হত্যা না করে আমাকে দিয়ে দাও। আমি তােমাকে এক বােঝা খড় দিচ্ছি। এবার ফরীদউদ্দীন বললেন, হ্যা, তাই দাও। আমার দাম এর চেয়েও কম। তাতারী বুঝল, তামাসা করা হচ্ছে। রাগে উত্তেজনায় ক্ষিপ্ত হয়ে সে তখনই তাকে এক কোপে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল “এভাবে দস্যুরা মানুষের ইতিহাসে চির কলঙ্কিত হয়ে থাকল। অপর দিকে, যুগ যুগান্তের জন্য আলােকময় উজ্জ্বল পুরুষ হিসেবে মানুষের হৃদয়ে ও ইতিহাসের খাতায় বেঁচে রইলেন হযরত ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ।
বিখ্যাত মসনবী শরীফে বিশ্বনন্দিত মরমী কবি আল্লামা হযরত জালালুদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহ শেখ আত্তারের প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন। এমনকি, তার একটি কবিতাও সংকলিত করেন মসনবী শরীফ গ্রন্থে।
হযরত ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ সম্পর্কে হযরত জালালুদ্দীন রুমী বলেন, দেড়শাে বছর পর আল্লাহ পাক তার ওপর আপন জ্যোতি অবতীর্ণ করেন। পারসিক কবি আল্লামা জামী বলেন, শেখ ফরীদউদ্দীনের বাক্যে অহাদানিয়াতের যে মাহাত্ম্য ও মারেফাতের গুঢ় রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়, তা অন্য কোন সুফী কবির কবিতায় মেলে না।
কেউ কেউ বলেন, তার রচিত পদ্য ও গদ্য গ্রন্থের সংখ্যা একশাে চৌদ্দ- কুরআন শরীফের সূরার সমসংখ্যক। এ বিষয়ে গাজী নূরুল্লাহ শােস্তরী হিমাতুল্লাহ-ও তাঁর রচিত গ্রন্থ মাজালেসুল মুমিনীনে অনুরূপ মত পােষণ করেন। তার রচিত তাযকিরাতুল আউলিয়া, মানতিকততায়ির, মুসবিততনামা, আসরারনামা, তাইসিরনামা, ইলাহীনামা, পেন্দেনামা, অসিয়ত, দীউয়ান, শারহুল কলব, খুশরুগােল খুবই উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। এইসব গ্রন্থ সারা বিশ্বে বিপুলভাবে আজও সমাদৃত হয়। এগুলির জনপ্রিয়তা কল্পনাতীত। বহু গ্রন্থকার বই কাটতির জন্য নিজের নামের বদলে শেখ ফরীদউদ্দীন রহমাতুল্লাহ-এর নাম ব্যবহার করেছেন, এও এক অভিনব ঘটনা বৈকি। নকল। শেখ ফরীদউদ্দীন রহমাতুল্লাহ-এর গ্রন্থের মধ্যে একখানি হল লিসানুল হাকীকত- যা এখনও লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সুরক্ষিত আছে।
“তাযকিরাতুল আউলিয়া গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি যা লিখেছেন, তাতে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিসত্তার স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় অনায়াসে। নম্রতা ও বিনয়ের সে এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব ছিলেন তিনি। নিজেকে অত্যন্ত দীন, হীন ও নিকৃষ্ট বলে মনে করতেন তিনি। আর সে কারণেই তত্ত্ব-জ্ঞানী ও আল্লাহ-প্রেমী হিসেবে মানুষের মনে তিনি চিরজাগরুক হয়ে রয়েছেন এবং থাকবেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থের বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীও অভিনব। সর্বপ্রথমে উচ্চারিত হয়েছে মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের প্রশংসা ও প্রশান্তি। পরের বিষয়ে এসেছে খােলাফায়ে রাশেদীনের খ্যাতি-সুখ্যাতি। তারপর শুরু হয়েছে আসল বক্তব্য। কিন্তু ভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। কাহিনীর নায়কেরা উপস্থাপিত হয়েছে পাখি রূপে। যেমন, হুদহুদ, তােতা, মােরগ, পায়রা, শানা, বুলবুল, বাজ ইত্যাদি।
কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে পাখিদের নিয়েই। যেমন- উল্লিখিত পাখি একদিন এক সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের মধ্য থেকে একজন বাদশাহ নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রকাশ করল এ.পদের জন্য সর্বপ্রথম ছী মােরগের নাম প্রস্তাব করল হুদহুদ পাখি। কিন্তু তার প্রস্তাবে কেউ রাজি হল না। কার কী আপত্তি, তাও তারা খুলে বলল। আর প্রত্যেকের বক্তব্য গভীর মনােযােগের সঙ্গে শুনে গেল হুদহুদ। তারপর, একে একে সকলের কথা খণ্ডন করল। তখন সর্বসম্মতি ক্রমে হী মােরগকেই তারা তাদের বাদশা নির্বাচিত করল। তারপর তার কর্মধারা সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে গ্রন্থকার প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতে উপস্থাপিত করেছেন। সাধারণতঃ তরীকতপন্থীদের মনে যে বিষয়গুলি জেগে ওঠে, সেগুলিকেই তিনি সংশ্লিষ্ট করেছেন এ গ্রন্থের মাঝে। এ ধরনের একখানি গ্রন্থ হল ‘মানতিকুত তায়ির’। পবিত্র কুরআনের সূরা নমল থেকে গ্রন্থখানির নাম চয়ন করা হয়েছে। | কুরআনে হুদহুদ পাখির উল্লেখ আছে। হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর প্রিয় পাখি হুদহুদ । বুঝতে পারা যায়, বুদ্ধিমত্তায় হুদহুদ পাখিই পক্ষিকুল শিরােমণি। আর হযরত ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ-ও তাঁর রচনামালায় হুদহুদকে এক বুদ্ধিদীপ্ত পাখি হিসেবে চিত্রিত করেছেন। পাখি নয়, যেন এক তত্ত্ব-জ্ঞানী হিসাবে কথা বলছেন।
কবিতা রচনার ব্যাপারেও তিনি সমকালের বহু কবিকে ছাড়িয়ে গেছেন। যাঁকে অদ্বিতীয় বলা চলে। কেউ কেউ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রশ্নে তাঁর সম্বন্ধে দ্বিমত পােষণ করেন। কিন্তু তাঁর জীবন ও সাহিত্য ছিল সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত ও সুন্দর তত্ত্বজ্ঞানে ভরপুর। | এ গ্রন্থ রচনা প্রসঙ্গ তাযকিরাতুল আউলিয়া’র গ্রন্থণা সম্পর্কে হযরত ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ আল্লাহ পাকের এবং তার পরে রাসূলে করীমের প্রতি প্রশংসার পর লিখেছেন, পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের পরে সাধক দরবেশগণের কালামই সবচেয়ে বেশী মর্যাদাশীল। কেননা সেগুলি আল্লাহর প্রেমের প্রাচুর্যে উজ্জ্বল, পার্থিব কলুষতা তাদের স্পর্শ করে না বলেই তারা সর্বজন মান্য বলে আমি মনে করি। সাধকগণের মধ্যে কেউ মারেফাতপন্থী, কেউ আল্লাহ প্রেমিক। কেউ কেবল একত্ববাদী। আবার কারও মধ্যে হয়তাে সব বৈশিষ্ট্যগুলিই বিদ্যমান। কারও মধ্যে হয়তাে বা রয়েছে সাধারণ ধরনের নিম্নস্তরের গুণাবলী।
যাই হােক, এই মহান প্রেমিকদের কাহিনী রচনার পেছনে তিনি কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যেমন, তিনি মনে করেন, কাজটি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এগুলি পাঠ করে পাঠকের জ্ঞানের প্রসারতা যদি বৃদ্ধি পায়, তবে তার লেখকের জন্য শুভকামনা জানাবেন। আর তাতে তার কবরও প্রশস্ত হতে পারে। একে নাজাতের ওসিলাও করা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
যেমন- বুআলী দাক্কাককে প্রশ্ন করা হয়, মহান তাপসগণের প্রত্যক্ষ উপদেশ যখন পাওয়া যায় না, তখন তাঁদের বাণী কোন মাধ্যম দ্বারা শুনে কি উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারে?
তিনি ইতিচাচক উত্তর দিয়ে বলেন, মহৎ লােকদের ঘটনা শুনলে শ্রোতার মনে সৎ সাহস ও আল্লাহর প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পায়। অহমিকা দূর হয়। ন্যায়-অন্যায় বিচারবােধ জাগে। কোনটি ভালাে, কোনটি মন্দ তা তার চোখ দেখতে পায়।
শেখ মাহফুজ রহমাতুল্লাহ রলেন, নিজের মানদন্ডে কাউকে বিচার করাে না। বরং আউলিয়াদের মানদন্ড ব্যবহার কর। তবেই তাদের মহত্ব ও নিজের ক্ষুদ্রত্ব উপলব্ধি করতে পারবে। |
জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-কে প্রশ্ন করা হয়, সাধক দরবেশের গল্পগাথা শুনে বিশেষ কি উপকার হয়? বাগদাদী রহমাতুল্লাহ বলেন, এদের পবিত্র বাণীগুলি আল্লাহর সৈন্যের ন্যায়। এগুলি দুর্বল মনকে সবল করে। অন্তরে সাহস এনে দেয়। পাঠক এগুলি থেকে সাহায্য পায়। কুরআন শরীফে আল্লাহ বলছেন, হে মুহাম্মদ! আমি আপনার কাছে নবী-রাসূলের কাহিনী বলছি। এতে আপনার মনে শক্তি ও সাহসের সঞ্চার হবে এবং আপনি মনে শান্তি লাভ করবেন।
হযরম মুহাম্মদ (সঃ) বলেন, ধার্মিক ও ওলীদের জীবন কাহিনী আলােচনা মাহফিলে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়। আর এ রহমত প্রাপ্তির আশায় যদি কেউ দপ্তর বিছিয়ে দেয়, তবে যতদূর সম্ভব তিনি বিফল হবেন না।
এই বিপর্যয়ের যুগে তাপসগণের জ্যোতির্ময় জীবন মানুষকে সাহায্য করে। মৃত্যুর পূর্বে সৌভাগ্য অর্জন করে ধরাধাম থেকে বিদায় নেওয়া সম্ভব হয়।
হযরত ফরীদউদ্দীন রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি যখন কুরআন-হাদীসের পর তাপসগণের বানীকে উত্তম এবং কুরআন-হাদীস অনুযায়ী তাদেরকে উত্তম বন্ধুরূপে দেখতে পেলাম, তখন তাদের জীবনালেখ্যর বিষয় আলােচনা করতে আত্মনিয়ােগ করলাম। যদিও আমি তাদের সমপর্যায়ভুক্ত নই, তবুও তাদের এই কাজকে ব্রত হিসাবে গ্রহণ করলাম। কেননা হাদীসে রয়েছে, যে লােক যে দলের অনুসরণ করে, সে রােজ কিয়ামতে সে দলেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।
হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ বলেন, যে নিজেকে হাকীকত-পন্থী বলে প্রকাশ করে, তুমি তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখ, তার চরণধুলি গ্রহণ কর। কেননা, তার মনে যদি এ ব্যাপারে সাহস না থাকত, তাহলে সে এই দাবী না করে অন্য যে কোন বস্তুর দাবী করত।
হযরত আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ অনুধাবন করা জটিল ব্যাপার। তবে সাধক দরবেশগণের জীবন-কাহিনী তা বােঝার জন্য ভাষ্য গ্রহের কাজ করে। অতএব, তাযকিরাতুল আউলিয়া’ নামক এ গ্রন্থখানি ইরান, ইরাক ও তুরস্কসহ বিরাট এলাকার ভাষাভাষীদের জন্য ফারসী ভাষায় রচনা করা হল।
একটি সাদী নীতি হল, কেউ কারও ইচ্ছা-বিরােধী কথা বললে সে তার ওপর এমন বিরক্ত হয় যে, রাগের বশে তাকে মেরে ফেলতেও পারে অথচ, কথাটা মিথ্যে। এখন সহজেই ধরে নেওয়া যায়, একটি, মিথ্যে কথার যদি প্রভাব থাকে, তাহলে সত্য কথার প্রভাব শতগুণ বেশী হবে। আউলিয়াদের জীৱন-কাহিনী শততায় সমৃদ্ধ। অতএব, এর দ্বারা মানুষ পুরােপুরি প্রভাবিত হবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
তিনি আরও বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে মনে এই আশা পােষণ করে আসছি যে, সাধক-দরবেশগণের, আলােচনা ছাড়া আর কোন আলােচনা শুনব না ও হযরত বুআলী রহমাতুল্লাহ বলেছেন, আমার দুটি ইচ্ছা। এক, কুরআন পাকের আলােচনা শােনা, দুই, পূণ্যবান লােকের সাক্ষাৎ লাভ করা। যেহেতু আমি এখনও সম্পূর্ণ, লিখতে পড়তে বলতে জানি না; আমি এমন লােকের খোঁজ করি, যে আমাকে আল্লাহর ওলীদের কথা বলবে, আর আমি তা নীরবে শুনে যাব। অথবা, আমি তাদের কথা বলব, সে তা চুপচাপ শুনবে। এছাড়া আমার আর কিছুই কাম্য নয়।
সত্য বলতে কি, যদি জান্নাতেও তাদের বিষয়ে আলােচনা না হয়, তাহলে অধম বুআলী তেমন জান্নাত লাভেও প্রত্যাশী নয়। হযরত আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, আমারও মনের এই কথা। হযরত ইউছুফ হামদানী রহমাতুল্লাহ-কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, এ যুগ চলে গেলে আল্লাহর ওলীগণ যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন, তখন আমরা কি নিয়ে থাকব, বা তখন আমাদের অবলম্বন কি হবে, আমরা মনকে সান্ত্বনাই বা দেব কিসের, দ্বারা? তিনি জবাব দেন, এঁদের জীবনীগ্রন্থ থেকে প্রতিদিন কিছু কিছু পাঠ করবে। আর এসব নিয়ে আলাপ-আলােচনা করে দিন কাটাবে।
শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, ওলী-আউলিয়াগণের প্রতি আমার আকর্ষণ, শ্রদ্ধা ও ভক্তি ছেলেবেলা থেকেই। তাদের অমূল্য বাণী মনে শান্তি ও তৃপ্তি দেয়। নিয়ম হল, মানুষ তার প্রিয়জনের সান্নিধ্য চায়। আর তা সম্ভব না হলে, তার আলাপ-আলােচনায় মগ্ন থাকতে চায়। এটা মানুষের চিরন্তন রীতি। বলা বাহুল্য, এরই ভিত্তিতে আমি তাপসজীবনের ওপর এই গ্রন্থ রচনা করলাম। বিশেষ করে, যুগটাও এমন, যখন আল্লাহর প্রিয়জনদের বাণী অবলুপ্তপ্রায়।
তাছাড়া কিছু কিছু লােককে সাধক-দরবেশের বেশে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত ওলী একেবারেই দুর্লভ। এই পরিপ্রেক্ষিতে হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ, একদা আল্লামা শিবলী রহমাতুল্লাহ-কে বলেন, ‘দেখ ! তামাম দুনিয়া খোঁজ করে কোন প্রকৃত ওলী পাও কিনা। পেলে কথা নেই, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভালাে করে ধরে থাক।
হযরত শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ আরও বলেন, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি এ যুগে মানুষ অতিমাত্রায় পাপাসক্ত হয়ে আল্লাহর ওলীদের একেবারে ভুলে যাচ্ছে। এইজন্য তাদেরই স্মরণার্থে এই গ্রন্থ রচনা করে আমি এর নাম দিলাম ‘তাযকিরাতুল আউলিয়া” অর্থাৎ তাপস স্মরণিকা- যেন বিপথগামী মানুষ এ গ্রন্থ পাঠ করে তাদের কথা স্মরণ করে ও তাদের রীতিনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজেদের কল্যাণ সাধন করতে পারে। | দরবেশদের জীবন-কাহিনীও মানুষের কিছু উপকার করে। যেমনঃ
(১) তাঁদের অমূল্যবাণী মানুষের মন থেকে পার্থিব লােভ, মােহ ও ভালােবাসা দূর করে।
(২) পরকালের চিন্তা-ভাবনাও দূরীভূত হয়।
(৩) হৃদয়ে আল্লাহ প্রেমের সৃষ্টি হয়।
(৪) তাদের কাহিনী শুনে মানুষ পরকালের সম্বল লাভে তৎপর হয়।
(৫) আল্লাহর প্রতি প্রেম-বেদনায় পূর্ণ আল্লাহপ্রেমীদের হৃদয়গুলির বাস্তব রূপটি উপলব্ধি করা যায়।
হযরত শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি একান্তভাবে আশা করি যে, রােজ কিয়ামতে আল্লাহ এই ‘তাযকিরাতুল আউলিয়া গ্রন্থখানির বদৌলতেই হয়তাে আমাকে নাজাত দেবেন। সব রকমের নৈরাশ্যের মাঝেও অন্ধকারে হয়তাে মুক্তির আলাে দেখাবেন।
শেষ কথা’। সবশেষে তিনি দয়াময় দাতা আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা জানান, হে প্রভু! আপনি আপনার নবী-রাসূল ও তাঁর প্রিয় তাপস-তাপসীগণের উসিলায় আপনার মনােনীত পূণ্যবানদের থেকে এ অধম দাসকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না, আপনার অনুগ্রহ-দৃষ্টি থেকে বঞ্চিতও করবেন না।
করুণাময় প্রভু আমার! আমি আপনার প্রিয় বন্ধুগণের এক অধম দাস। আপনার দরবারে তার কাতর প্রার্থনা, আপনি তার এ গ্রন্থখানাকে আপনার দীদার লাভের উসিলা করে দিন। প্রভু গাে, জানি আপনি প্রার্থনা কবুলকারী । আল্লাহুম্মা আমীন, সুম্মা আমীন!
মনসুর হাল্লাজ এর জীবনী পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার
by MOHAKAL | Jun 21, 2021 | জীবনী
একবার কয়েকজন মহিলা এলেন সুবিখ্যাত ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্নটি হল, একজন পুরুষের এক সঙ্গে চার জন স্ত্রী রাখার অনুমােদন আছে। কিন্তু একজন স্ত্রী এক সঙ্গে দু’জন স্বামী গ্রহণ করতে পারে না, এর কারণ কি?
গুরুতর প্রশ্ন। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) সেই মুহূর্তে এর উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি অন্তঃপুরে এলেন। আর তাঁর বিদুষী বুদ্ধিমতী কন্যার কাছে প্রশ্নটি উত্থাপন করলেন। কন্যা বললেন, আপনি যদি আপনার নামের সঙ্গে আমার নামটি যুক্ত করেন, তাহলে আমি এর সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারি। পিতা তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, মহিলাদের তােমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি মা। তুমি তাদের বিষয়টি বুঝিয়ে দেবে।
তাই হল। মহিলারা তাঁর কাছে এলেন। তিনি তাদের সাবইকে একটি ঘরে পেয়ালায় কিছু দুধ আনতে বললেন। দুধ আনা হল। এবার অন্য একটি বড় পেয়ালায় প্রত্যেকের আনা দুধ ঢালতে বলা হল। মহিলারা তাও করলেন। সকলের আনা দুধ বড় পেয়ালায় মিশে গেল। তিনি আবার বললেন, এবার আপনারা যে যতটুকু দুধ এনেছেন, তা আবার আলাদা করে দিন।
তারা বললেন, তা কি সম্ভব? তিনি বললেন, তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে আপনারাই বলুন, কোন এক মহিলার একাধিক স্বামী থাকলে আর সন্তান ভূমিষ্ট হলে তা কোন স্বামীর সন্তান তা চেনবার উপায় কী?
এ প্রশ্নের আর উত্তর দেবার দরকার হল না। মহিলারা বললেন, প্রশ্নের জবাব আমরা পেয়ে গেছি। খুব খুশী হয়ে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর মেয়ের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করতে করতে তারা চলে গেলেন। খুশী ইমাম সাহেবও তাঁর কথামতাে ঐ দিন থেকেই তিনি তাঁর প্রিয় কন্যার নাম নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দিলেন। তার নতুন নাম হল আবু হানিফা। অর্থাৎ হানিফার পিতা। কন্যার নাম ছিল হানিফা। মহাকালের পৃষ্ঠায় পিতা-পুত্রীর নাম চিরদিনের মতাে মুদ্রিত হয়ে গেল।
বিশ্ব-নন্দিত ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ-এর আসল নাম নােমান। পিতার নাম সাৰিত। আর চিরভাস্বর উপাধি হল, ইমাম আজম-ইমামগণের ইমাম, শ্রেষ্ঠ ইমাম। তার সূর্যসম প্রতিভার আলােক-ধারায় শুধু শরীয়ত আর মারেফাতই উদ্ভাসিত হয়নি, পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর অন্তর্জোতিও বিস্তীর্ণ হয়েছে। সূক্ষাতিসূক্ষ্ম মাসআলা-সমূহের সমাধানে ও জটিলতম বিষয়-সমূহের মর্মোদঘাটনে তিনি যে নৈপুণ্য ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, জগতে তার কোন তুলনা নেই। বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী এই মহাপন্ডিত সাহাবায়ে কেরাম ও শ্রেষ্ঠ ওলী আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাহচর্য লাভ করেন। যাদের সাহায্য লাভ করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন- আনাস ইবনে মালেক, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রুমী, ওয়াসেক বিন ওয়ারাকা রহমাতুল্লাহ প্রমুখ।
হযরত জাফর সাদেক রহমাতুল্লাহ তার পরম বন্ধু ছিলেন। হযরত ফোজায়েল রহমাতুল্লাহ, ইব্রাহীম আদহাম রহমাতুল্লাহ, বিশর হাফী রহমাতুল্লাহ, দাউদ তায়ী রহমাতুল্লাহ প্রমুখ তাপসগণের তিনি ছিলেন মারেফাত বিদ্যার শিক্ষক। আর শরীয়তী শিক্ষাধারায় তার উজ্জ্বল শিষ্যগণ হলেন ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহ, ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহ ও ইমাম মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ অন্যান্য জ্যোতিষ্ক।
কথিত আছে, পাক রওজায় উপস্থিত হয়ে তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সম্বােধন করে বলেন, আস্সালামু আলাইকুম ইয়া সাইয়্যিদাল মুরসালীন- হে রাসূলগণের সর্দার, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হােক। তখন রওজা মুবারক থেকে জবাব আসে, ওয়া আলাইকুমুস সালামু ইয়া ইমামাল মুসলিমীন- হে মুসলিমগণের ইমাম, আপনার ওপরও শান্তি বর্ষিত হােক।
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যাকে মুসলিমগণের ইমাম বলে সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছেন, তার মর্যাদা কোথায় গিয়ে পৌছায়, চিন্তা করলে আবেগ আপুত হতে হয়। তিনি এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলেন এক রাতে রাসূলুল্লাহর পাক রওজা থেকে তিনি পবিত্র অস্থি তুলে জমা করছেন এবং একখানা আরেক খানা থেকে পৃথক করছেন। এই স্বপ্ন দেখে ভয়ে অস্থির হয়ে তিনি জেগে উঠলেন এবং বিখ্যাত স্বপ্নবিশারদ আল্লামা ইবনে সবীনের এক শিষ্যের কাছে গিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইলেন। তিনি বললেন, এ স্বপ্নের অর্থ আপনি মহানবীর জ্ঞানরাজী, ফেকাহ ও হাদীসশাস্ত্রে এরূপ বুৎপত্তি লাভ করবেন। এ ছারাও উক্ত শাস্ত্র-সমূহের ভাষ্যকার হবেন। আর সত্যকে অসত্য থেকে পৃথক করার ক্ষমতা আল্লাহ আপনাকে দান করবেন। বলাবাহুল্য, এ স্বপ্ন আক্ষরিক অর্থে ফলবতী হয়। তিনি আরও একবার স্বপ্ন দেখেন, নবী মুস্তফা (সাঃ) তাঁকে সম্বোধন করে বলছেন, হে আবু হানিফা, আল্লাহ আপনাকে আমার সুন্নত তরীকা জীবিত রাখার জন্য সৃষ্টি করেছেন, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। নির্জনবাস করবেন না। শরীয়তের বিধান রক্ষার তিনি ছিলেন এক অতন্দ্র প্রহরী।
এ বিষয়ে একটি ঘটনা অবশ্যই উল্লেখযােগ্য। তখন মুসলিম দুনিয়ার খলীফা আল মনসুর। তিনি বাগদাদের প্রধান কাজী ও অন্যান্য ওলামাকে ডেকে পাঠালেন। তারা এসে উপস্থিত হলেন। ওদিকে খলীফা মনসুর তার এক বিশেষ অনুচরকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন খলীফার প্রত্যেক সহচরের নামে কিছু কিছু জমি-জায়গা লিখে দেন। নির্দেশ অনুযায়ী সে কাজও সম্পন্ন হল। তারপর সাক্ষীস্বরূপ দস্তখত নেবার জন্য খলীফা তার এক সহচর মারফত দলিলগুলি পাঠিয়ে দিলেন প্রধান কাজী সাহেব ও অন্যান্য আলেমদের কাছে। প্রথমে প্রধান কাজী ও পরে অন্যান্য সই দিলেন। কিন্তু বেঁকে বসলেন আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ। সই না করে রাজকর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন, খলীফা এখন কোথায় কর্মচারী জানালেন, তিনি এখন বালাখানায়। ইমাম আজম বললেন, হয় আমাকে ওখানে নিয়ে চলুন না হয় তাকে এখানে আসতে বলুন। তবে সাক্ষ্য সঠিক হবে। কর্মচারী বললেন, প্রধান কাজীসহ সবাই যখন সই করছেন, তখন আপনি অযথা আপত্তি করছেন কেন? ইমাম আবু হানিফা বললেন, সে জেনে আপনার কাজ নেই। যা বলছি, করুন।
শেষ পর্যন্ত এ ঘটনা খলীফার কানে গেল। তিনি প্রধান কাজীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি দস্তখত করার সময় তা উপস্থিত থেকে শুনেছেন বা দেখেছেন? কাজী জবাব দিলেন, আমি বুঝতে পেরেছি যে, সেগুলি আপনার ইচ্ছাক্রমেই হয়েছে। তাই উপস্থিতির প্রয়ােজনবােধ করিনি। খলীফা বললেন, আপনার এ কাজ ন্যায়সঙ্গত হয়নি। তাই আপনাকে আপনার পদ থেকে খারিজ করলাম। অতঃপর প্রধান কাজীর পদে চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে যেকোন একজনকে নিযুক্ত করার কথা ভাবা হল। এঁরা হলেন- ইমাম আবু হানিফা, সুফিয়ান, শােয়হ ও ইমাম শা’বী । তাদের দরবারে ডাকা হল। একই সঙ্গে আসছিলেন তারা। পথিমধ্যে ইমাম আবু হানিফা বললেন, শুনুন, আমি যে কোনভাবে হােক, এই পদ গ্রহণ করব না, সুফিয়ান আপনি সরে পড়েন। শাবী পাগলের ভান করুন। আর শােয়হ পদটি গ্রহন করুন। তার এ পরামর্ষে সুফিয়ান সত্যিই সরে গেলেন। বাকী তিন জন দরবারে হাজির হলেন।
খলীফা প্রথমে ইমাম আবু হানিফা (রাঃ)-কে পদটি গ্রহণ করার অনুরােধ জানালেন। তিনি বললেন, আমি আরবের লােক নই। অতএব আর প্রধানগণ সহজে আমার হুকুম মানতে চাইবে না। জাফর বারমাকী নামে একজন আমীর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, গােলের সঙ্গে এ পদের সম্পর্ক কি? এবার ইমাম বললেন, আমি এ পদের যােগ্য নই। এর প্রমাণ হল, আমার এ কথা হয় সত্য, নয় মিথ্যা হবে। সত্য হলে তাে আমি এ পদের উপযুক্ত নই। আর যদি মিথ্য হয়, তাহলে একজন মিথ্যাবাদীকে এরূপ দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করা ঠিক নয়। একথা বলে আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ রেহাই পেলেন।
ইমাম শা’বী খলীফার হাত ধরে বললেন, জনাব, আপনি ভালো আছেন তো! আপনার পরিবার-পরিজন কেমন আছেন, খলীফা তার কথাবার্তর ধরন দেখে বুঝলেন, নিশ্চয় ভদ্রলােকের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে।
এবার শােরায়হের পালা। তিনি বললেন, আমার মস্তিষ্ক অত্যন্ত দুর্বল। আমার পক্ষে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করা সম্ভব নয়। তার কথা শুনে খলীফা বললেন, আপনি চিকিৎসা করান। রােগ সেরে যাবে। শেষ পর্যন্ত সােরায়হকেই কাজীর পদে বহাল করা হল। এরপর হতে আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ শােয়হর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। এমনকি তার সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করলেন।
কাজীর পদ গ্রহণ না করার কারণ হল, তখনকার আলেমগণ প্রায় সকলেই স্বাধীনচেতা ছিলেন। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যাকে কাজী নির্বাচিত করা হয়েছে, তাকে ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এ মন্তব্য জানা ছিল বলে তারা এ ব্যাপারে খুবই সন্ত্রস্ত ছিলেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর বৈঠক শুরু হয়েছে। পাশে কয়েকটি ছেলে বল খেলছিল। হঠাৎ বলটি একবার এসে পড়ল আসরের মাঝখানে। আর কোন বালকই সেটা নিতে সাহস করল না। কিছুক্ষণ পরে একটি ছেলে সভাস্থ কাউকে সমীহ না করে, বলটি আসর থেকে তুলে নিয়ে গেল। তার হাবভাব দেখে ইমাম বললেন, এ নিশ্চয় কোনও জারজ সন্তান। এতটুকু লজ্জাবােধ নেই, এরপর জানা গেল, তার কথাই সত্য। প্রকৃতই ছেলেটি এক অবৈধ সন্তান।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর ধর্মনিষ্টা কিংবদন্তিতুল্য। একবার কোন এক লােক তার থেকে টাকা ধার নেয়। লােকটির বাড়ী যে পল্লীতে সেখানে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর এক শিষ্য মারা যায়। তিনি সেখানে গেলেন তার জানাযা আদায় করতে। তখন দুপুর। প্রচণ্ড গরম আর রােদও তত্র। সেখানে ঐ টাকা ধার গ্রহণকারীর দালানের ছায়া ছাড়া মাথা বাঁচানাের আর কোন উপায় ছিল না। কিন্তু সকলের অনুরােধ সত্ত্বেও ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ ঐ জায়ায় গিয়ে দাঁড়ালেন না। বললেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কাউকে কিছু ধার দিয়ে তার থেকে কোন উপকার গ্রহণ করবে না। অতএব, তার দালানের ছায়ায় আরাম ভোগ করা ঠিক হবে না। কেননা, তা হবে সুদ গ্রহণের মতাে।
দাউদ তায়ী রহমাতুল্লাহ বলেন, দীর্ঘ বিশ বছর ধরে তিনি তার সেবায় রত থেকেও তাকে প্রকাশ্যে বা গােপনে খালি মাথায় কখনও বসে থাকতে দেখেননি অথবা অবসন্ন অবস্থায় কোনদিন পা ছড়িয়ে বসেননি। যেখানে কোন লােকজন নেই, সেখানে একটু পা ছড়িয়ে বসলে কী? তার এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, সেখানেও আল্লাহর সঙ্গে শিষ্ঠাচার রক্ষা করা চাই।
প্রতি রাতে তিনি তিনশ রাকাআত নফল নামাজ পড়তেন। একদিন তার কানে এল, এক মহিলা অন্য এক মহিলাকে বলছেন, ইনি প্রতি রাতে পাঁচ’শ রাকাআত নফল নামাজ পড়েন। সেদিন থেকে তিনি পাঁচ’শ রাকাআত নফল নামাজ পড়তে শুরু করলেন। আবার একদিন তাকে দেখিয়ে কয়েকজন লােক বলাবলি করছিল, ইনি রােজ রাতে হাজার রাকআত নফল নামাজ আদায় করেন। সেদিন থেকে তিনি সত্যিই হাজার রাকআত নামাজ পড়তে লাগলেন। আরও কিছুদিন পর তার এক শিষ্য এসে বললেন, লােকের মুখে শুনা যায়, আপনি সারা রাত নামাজে কাটিয়ে দেন। সেদিন থেকে সত্যিই তিনি সারারাত নফল নামাজে রাত কাটাতে শুরু করলেন। আর তখন থেকে একটানা ত্রিশ বছর এশার অযুতে ফজর আদায় করতেন। মানুষের উচ্চ ধারণার কী অপরিসীম মূল্য তিনি দিয়েছেন।
হযরত দাউদ তায়ী রহমাতুল্লাহ যখন শাসনকর্তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন তার কর্তব্য সম্বন্ধে তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর পরামর্শ চান। তিনি বলেন, এখন থেকে তােমার এলেম অনুযায়ী কাজ করা উচিত। কেননা, এলেমানুরূপ কাজ যে করে না, তার দেহ প্রাণহীন গােশত পিণ্ডের মতাে।
একদিন শহরের এক হাম্মামখানায় এক উলঙ্গ ব্যক্তিকে দেখে তিনি চোখ বুজে ফেলেন। লােকটি তাকে বলল, কবে থেকে আপনার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, যেদিন থেকে তােমার হায়া- শরম ভুলে গেছ।
একদিন বাজারে যেতে তার কাপড়ে কিছু কাদামাটি লেগে গেল। তিনি তখনই নদীতে গিয়ে তা ধুয়ে ফেললেন। কেউ তাঁকে বললেন, আপনি যে পরিমাণ ময়লা জায়েয রেখেছেন, এতাে তার চেয়ে কম। না ধুলেও চলত। তিনি বললেন, আমি যা বলেছি, ওটা ফতোয়ার কথা। আর যা করলাম তা পরহেজগারী। রাসূলে কারীম (সঃ) একদিন হযরত বেলাল (রাঃ)- কে বললেন, কোন সময় আধখানা রুটিও জমা করে রাখবে না। অথচ কোন এক সময় তিনি তার পত্নীদের জন্য প্রায় এক বছরের খাবারও জমা করে রেখেছিলেন।
এক ব্যক্তি ঈর্ষা-প্রণােদিত হয়ে হযরত ওসমান রহমাতুল্লাহ- কে ইহুদী বলত ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) একদিন তাকে ডেকে বললেন, আপনার কণ্যার সঙ্গে অমুক ইহুদীর বিয়ে দেব। সে বলল, আপনি নিজে মুসলমান হয়ে ইহুদীর সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চান? ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বললেন, কেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাে ইহুদীর সঙ্গে দু’জন মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, লােকটি তার কথার মর্ম বুঝতে পেরে ভীষণ লজ্জিত হয়ে তার কাছে তওবা করে ক্ষমা চেয়ে নিল। একদিন এক ধনী ব্যক্তিকে তার ধন সম্পদের জন্যই তিনি একটু বেশ সম্মান দেখান। কিন্তু পরে অনুতপ্ত হয়ে এক হাজার বার কোরআন শরীফ খতম করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি আরও একটি নিয়ম পালন করতেন। কোন কঠিন মাসআলার সম্মুখীন হলে চল্লিশ বার পবিত্র কোরআন খতম করে সমাধানে রত হতেন।
তৎকালীন খলীফা রাতে স্বপ্ন দেখলেন, আজরাইল ফেরেশতাকে তার আয়ুর কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের দিকে ইশারা করে দেখালেন। বিভিন্ন গণ্ডিতের কাছের স্বপ্নের ব্যাখ্যা চেয়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি হযরত আবু হানিফা রহমাতুল্লাহকে ধরলেন। তিনি বললেন, পাঁচটি আঙ্গুল দ্বারা পাঁচটি বিষয়ের ইঙ্গিত করা হয়েছে- যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। সেগুলি হলঃ
(১) কিয়ামত কবে হবে, (২) বৃষ্টি কখন হবে, (৩) কয়টি সন্তান হবে (৪) কোন্ জায়গায় কার মৃত্যু হবে ও (৫) আগামীকাল কী ঘটবে।
হযরত আবু আলী রহমাতুল্লাহ বলেন, তিনি এক রাতে হযরত বেলাল রহমতুল্লাহ -এর কবরের পাশে শুয়েছিলেন। সে রাতে স্বপ্ন দেখেন, তিনি যেন মক্কায় আছেন। আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বৃদ্ধকে শিশুর মতাে কোলে নিয়ে বনী শায়বা দরজা দিয়ে বের হয়ে এলেন। তিনি তাড়াতাড়ি গিয়ে তার কদমবুসি করলেন। তিনি তখন অবাক হয়ে ভাবছিলেন নবী করীমের কোলে কে এই বৃদ্ধ? নবীজী বললেন, ইনি মুসলিমদের ইমাম আবু হানিফ। নওফেল ইবনে হাইয়ান বলেন, ইমাম আবু হানিফা এর মৃত্যুর পর তিনি স্বপ্ন দেখেন কিয়ামত হয়ে গেছে। সমস্ত মানুষ হাশরের মাঠে হাজির। রাসূলে কারীম (সঃ) দাড়িয়ে আছেন হাওজে কাওসারের কাছে। তার ডানে-বামে প্রচুর বিজ্ঞানীর ভিড়। তিনি দাড়িয়ে আছেন মহানবীর দিকে মুখ করে। ইমাম সাহেব রয়েছেন তাঁর পাশে। আমি তাকে সালাম করে বললাম, আমাকে একটু পানি পান করান। তিনি জবাব দিলেন, নবীজী নির্দেশ দিলে পানি দিতে পারি , রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশে আমাকে পানি দেওয়া হল। পানি পান করে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পাশে উনি কে পঁড়িয়ে আছেন? তিনি বললেন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর বাম পাশে হযরত আবু বকর (রাঃ)। তারপর একে একে অন্যান্য বিশিষ্ট জনের পরিচয় নিয়ে আঙ্গুলের করে গুনে হিসাব করতে লাগলাম। আমি সতেরাে জনের নাম শুনলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম আমার বুড়ো আঙুলটি করের সতেৱাে দাগেই রয়েছে।
আরও পড়তে উইকিপিডিয়ায় দেখুন
খাজা বাবার জীবনী পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
To read Jalaluddin Rumi’s biography click here.